ইসলামী শরিয়তের বিধানাবলিকে স্তরভেদে সাজানো হয়েছে। কোরআন ও হাদিসের বিস্তারিত বর্ণনায় ইসলামী শরীয়তের সব বিধানাবলীর স্তরবিন্যাস না থাকলেও মুসলিম উম্মাহর ফকিহ ও আইনবিদগণ কোরআন ও সুন্নাহ গবেষণা করে ইসলামি শরীয়তের বিধানাবলিকে বিভিন্ন স্তরে সুবিন্যস্ত করেছেন।
ইসলামী শরীয়তের আদেশসমূহ যথা—ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব ইত্যাদি। আর নিষেধসমূহ যথাক্রমে— হারাম ও মাকরুহ ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা আদেশ-নিষেধ কোনোটির পর্যায়ের পড়ে না। বরং শুধু ঐচ্ছিক বা বৈধতার পর্যায়ে পড়ে।
নিম্নে সংজ্ঞা ও বিধানসহ বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো—
ফরজ -
অকাট্যভাবে প্রমাণিত আদেশমূলক বিধানকে ফরজ বলা হয় এবং সেই বিধানের অকাট্যতার ওপর পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস রাখা ও আমল করা আবশ্যক। যদি কোনো ব্যক্তি বিনা ওজরে তা পরিত্যাগ করে তাহলে তাকে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয় এবং সেই বিধানাবলী অস্বীকারকারীকে ‘কাফির’ বলে গণ্য করা হয়। (উসুলে সারখসি : ১/১১০)
ফরজ দুই প্রকার :
১. ফরজে আইন
২. ফরজে কিফায়া।
১. ফরজে আইন :
যে বিধানের উপর প্রত্যেক বিবেকবান নর-নারীর আমল করা বাধ্যতামূলক তাই ফরজে আইন। অর্থাৎ কোন এক গোত্র বা সমাজের আমলের কারণে অন্যরা দায়মুক্ত হয় না। বরং তা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর আবশ্যক। যথা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জাকাত (সম্পদশালী ব্যক্তির ক্ষেত্রে), রমজানের রোজা ও হজ (সামর্থবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে) এবং প্রয়োজনীয় দ্বীনি ইলম অর্জন করা ইত্যাদি।
২. ফরজে কিফায়া :
যে বিধান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর এককভাবে আবশ্যক নয়। বরং মুসলিম সমাজের ওপর বিধানটি এমনভাবে আরোপিত মুসলিমদের একটি দল সঠিকভাবে আমলটি পালন করলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যায়। তবে যদি কেউ সেই আমলটি পালন না করে তাহলে সকলেই গোনাহগার হবে। যথা - জানাজার নামাজ, পরিপূর্ণ দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করা, সৎ কাজের আদেশ ইত্যাদি।
ওয়াজিব-
ওয়াজিব একটি আদেশমূলক বিধান যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং তা পালন করা আবশ্যক। কোনো বিনা ওজনের ওয়াজিব ত্যাগকারী গুনাহগার হবে এবং অস্বীকারকারী ‘ফাসিক’ বলে গণ্য হবে। তবে ওয়াজিব ত্যাগকারী ব্যক্তিকে ‘কাফির’ বলা যাবে না। যথা— বিতরের নামাজ, সদকাতুল ফিতর ও কোরবানি হুকুম ইত্যাদি।
সুন্নত-
সুন্নত হচ্ছে এমন একটি হুকুম যা ফরজ ও ওয়াজিবের মত অবশ্যই পালনীয় বিষয় না হলেও তা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়মিত আমল থেকে প্রমাণিত।
সুন্নত দুই প্রকার :
১. সুন্নতে মুয়াক্কাদা
২. সুন্নতে জায়েদা।
১. সুন্নতে মুয়াক্কাদা :
সুন্নতে মুয়াক্কাদা এমন একটি হুকুম , যা রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত আমল করতেন এবং বিনা ওজরে তা পরিত্যাগ করতেন না। যথা—পুরুষদের জন্য জামাতে নামাজ আদায় করা, নামাজের জামাতের জন্য আজান দেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের সুন্নত ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধান হচ্ছে— বিনা ওজরে নিয়মিত ছেড়ে দিলে গুনাহ হবে, তবে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ছাড়তে পারে। বিনা প্রয়োজনে সুন্নতে মুয়াক্কাদা ত্যাগকারীকে তিরস্কার করা হবে, তবে তাদেরকে ফাসিক বা কাফির বলে গণ্য করা যাবে না।
২. সুন্নতে জায়েদা :
সেসকল সুন্নত আমল রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত করলেও বিনা ওজরেই মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিতেন। সেই সকল আমলকে মুস্তাহাব, নফল, মানদুবও বলা হয়ে থাকে। সুন্নতে জায়েদার বিধান হলো—এর ওপর আমল করা সত্যিই প্রশংসনীয় ও সওয়াবের কাজ হলেও। বিনা প্রয়োজনেই তা ত্যাগকারীকে কোনোভাবেই তিরস্কার করা যাবে না। যথা- তাহাজ্জুদের নামাজ , অন্যান্য নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল সদকা, পরোপকার ও জনসেবামূলক কাজ ইত্যাদি। তবে এ কোন কোন আমলের ক্ষেত্রে অন্য আমলের চেয়েও অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। ওলামায়ে কেরামদের মতে, মুস্তাহাব-নফলের চেয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুন্নতে জায়েদা তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ। (কাশফুল আসরার : ২/৩০২)
হারাম-
হারাম হলো এমন একটি হুকুম যা ফরজের বিপরীত। হারাম এমন নিষেধাজ্ঞা মূলক বিধানকে বলা হয়, যা ইসলামী শরীয়তে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। হারাম বিধানের অকাট্যতার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখা ও তা পরিত্যাগ করা অপরিহার্য। ইসলামী শরীয়ত শিথিলতা দেখায় এমন ওজর ব্যতীত কোন ব্যক্তি হারাম কাজে লিপ্ত হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সে ‘ফাসিক’ বলে বিবেচিত হয়। নিষিদ্ধতার এই হুকুমকে অস্বীকারকারী ব্যাক্তি ‘কাফির’ বলে গণ্য হয়। যথা : ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা বলা, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, মদপান, ছিনতাই, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ-ঘুষ গ্রহণ, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া ইত্যাদি।
মাকরুহ-
মাকরুহ হচ্ছে এমন একটি নিষেধমূলক বিধান, যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত বিধায় তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। তবে বিনা ওজরে তাতে কেও লিপ্ত হলে তাকে ‘ফাসিক’ বলা যাবে না এবং শাস্তির আওতায় আনা যাবে না।
মাকরুহ দুই প্রকার :
১. মাকরুহে তাহরিমি
২. মাকরুহে তানজিহি।
১. মাকরুহে তাহরিমি :
মাকরুহে তাহরিমি যা সরাসরি হারাম না হলেও হারামের প্রায় কাছাকাছি। তাই বিনা ওজরে তাতে লিপ্ত ব্যক্তি গুনাহগার ও তিরস্কৃত হবেন। যথা : দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা ইত্যাদি। মাকরুহ এর এই প্রকারকে ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদার পুরোপুরি বিপরীত বলা যায়।
২. মাকরুহে তানজিহি :
যে মাকরুহ হালালের পর্যায়ে না হলেও বৈধতার দিক থেকে হালালের কাছাকাছি। তা থেকে বিরত ব্যক্তি সর্বদায় প্রশংসার দাবী রাখে, তবে তাতে লিপ্ত ব্যক্তি তিরস্কারযোগ্য নয়। এ প্রকার মাকরুহকে সুন্নতে জায়েদা ও মুস্তাহাবের বিপরীত বলা যায়। (উসুলে সারখসি : ১/১১০)
মুবাহ :
ইসলামী শরিয়তে যে বিষয়ে কোনো আদেশ বা নিষেধ করা হয়নি তাকেই মুবাহ বা জায়েজ বলা হয়। যথা : দুনিয়াবি বিভিন্ন কাজকর্ম। তবে লক্ষ্যণীয় যে ভালো নিয়তের কারণে কোনো মুবাহ কাজ মুস্তাহাব বা সাওয়াবের কাজও হতে পারে। আবার এই মুবাহ ক্ষেত্রবিশেষ শুধুমাত্র খারাপ নিয়তের কারণেই তা গুনাহের কারণ হতে পারে। যথা : কারিগরি শিক্ষা হালাল রিজিক, দেশ, জনসেবা ও দ্বিনের কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে শিখলে তা সাওয়াবের কাজ, আবার একই শিক্ষা তা যদি গুনাহের কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে শেখা হয় তাহলে তা গুনাহের কাজ। (আলআশবাহ ওয়ান্নাজায়ের : ১/২৩)
পোস্ট ট্যাগ -
ওয়াজিব নামাজ কি কি , সালাতের ওয়াজিব কয়টি কি কি , ইসলামের ১৩০ ফরজ কি কি , ওয়াজিব কি কি , মুস্তাহাব কি , ইসলামে মোট ফরজ কয়টি , নফল কি , ওয়াজিব কাকে বলে উদাহরণ সহ লেখ