পৃথিবী তার আপন গতিতে ছুটে চলেছে। এই গতিময় যান্ত্রিক পৃথিবীর সাথে মানুষ নিজেকে খাপ খাওয়াতে দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছ মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষের জীবনে কাজই কি সব? কাজ কখনোই মানব জীবনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না। যান্ত্রিকতার সাথে অবিরাম কাজ করতে করতে আমরা একসময় ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। শারীরিকভাবে ক্লান্ত হওয়ার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে মানসিক অবসাধও। একপর্যায়ে জীবনের সবকিছু অর্থহীন ও জীবনের সব অর্জনকে তুচ্ছ মনে হয়। এমতাবস্থায় আমাদের শরীর ও মন অবকাশের প্রয়োজন অনুভব করে।
১। মানসিক প্রশান্তি লাভে অবকাশ:
মানুষ মাত্রই তার প্রয়োজনীয় চাহিদা থাকবে। আর আমরা আমাদের নানা রকম চাহিদা পূরণে ব্যস্ত সময় পার করে থাকি। কর্মব্যস্ততাই আমাদের জীবনকে গতি দিয়ে থাকে। কাজের ব্যস্ততা আমাদের আজেবাজে চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত রাখে। কিন্তু এ কর্মব্যস্ততাই আবার মাঝে মাঝে আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে। আমরা কর্মব্যস্ত জীবনের কৃত্রিম জালে আবদ্ধ হয়ে ভাবলেশহীন যন্ত্রের ন্যায় বিরামহীন কাজকর্ম চালিয়ে যাই। ব্যস্ততার এ জাল থেকে বেরিয়ে অবকাশ যাপনের সুযোগ থাকে না। আমরা কর্মব্যস্ত জীবনের কাছে নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে উৎসর্গ করে দেই। কিন্তু এই যান্ত্রিকতার প্রভাব খুবই ক্ষতিকর। অবকাশহীন একঘেয়ে কর্মব্যস্ততা আমাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলে। এর কারণে দেখা দিতে পারে নানা রকম জটিল মনোরোগ। এতে আমাদের মাঝে স্থায়ীভাবে হতাশা ও বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। তাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে অবকাশের বিকল্প নেই।
২। শারীরিক সুস্থতায় অবকাশ:
বিরামহীন কাজের ফলে আমরা নানা রকম শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। মানবদেহ অসংখ্য কোষ রয়েছে। প্রতিদিন আমরা যে পরিশ্রম করি তার ফলে আমাদের দেহের কিছু কিছু কোষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় বা পুরোপুরি মারা যায়। কাজ শেষে বিশ্রাম নেওয়ার ফলে সেই কোষগুলি পুনরায় উজ্জীবিত হয় বা নতুন করে কোষ তৈরি হয়। তাই বিরামহীন কাজ না করে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেয়া আবশ্যক। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে ‘সুস্থ দেহ, প্রফুল্ল মন, কর্মব্যস্ত সুখি জীবন।’ দেহ সুস্থতায় কাজ আনন্দময় হয়। সাফল্যের মূলই হচ্ছে শারিরীক সুস্থতা। শরীর সুস্থ না থাকলে মনও সুস্থ্য থাকে না। তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অবকাশ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
৩। বিশ্রাম ও কাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত:
প্রত্যেক মানুষই ধন-সম্পদ ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ হতে চায়। সবাইকে পেছনে ফেলে সফলতার উচ্চ শিখরে উঠতে চায়। আমাদের সমাজে একে অন্যকে পেছনে ফেলার প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে। এ প্রতিযোগিতা মানুষকে উম্মাদ বানিয়ে ফেলে। যে করেই হউক নিজেকে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছাতেই হবে, তাই সামান্যতম অবকাশ দিতে চায় না। অবকাশহীন পরিশ্রমকেই সাফল্যের একমাত্র পথ মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অবকাশহীন একটানা পরিশ্রম সাফল্যের ক্ষেত্রে বাঁধা তৈরী করে। অবকাশ আমাদের কাজের উদ্যম বাড়ানোর পাশাপাশি শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। ফলে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করলে তা বেশি সফল হয়।
৪। অবকাশ যাপনের বিভিন্নতা:
পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের স্বভাবেরও ভিন্নতা রয়েছে। তাই জীবনযাত্রাতেও রয়েছে ভিন্নতা। আর তাই তাদের তাদের প্রত্যেকের অবকাশ যাপনেরও রয়েছে ভিন্নতা। কেউ অবকাশে নিস্তব্ধ প্রশান্তি খোঁজে আবার কেউ চায় হৈ-হুল্লোড়। কেউ চায় অবসরে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য, কেউ আবার একলা চলে নিজের জীবনকে উপভোগ করতে চান। অবসরে অনেকে পর্বতের বিশালতার উদার সৌন্দর্য দর্শনে যায়, আবার কেউ যায় সমুদ্রের গভীরতার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কেউবা ভালোবাসেন নিবিড় বনের স্তব্ধ পরিবেশে উপভোগ করতে। অনেকেই অবকাশ কে উপভোগ করেন গান, নাটক সিনেমা দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় আড্ডা দিয়ে। আবার বইপ্রেমীরা অবসর পেলেই কবিতা ও উপন্যাসের কল্পনার জগতে হারিয়ে যান। অনেকেই আবার একটু অবসর পেলেই চষে বেড়ান পৃথিবীর প্রান্তে। আরও নানাভাবে আমরা অবকাশযাপন করে থাকি। একঘেয়ে জীবনকে সাময়িক ছুটি দিয়ে উপভোগ করুন জীবনের নানামাত্রিক সুখ।
৫। ছাত্রজীবনে অবকাশ:
ছাত্রজীবনে একজন ছাত্রের প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা হলেও কিন্তু বিরামহীন পড়া, ক্লাস ও পরীক্ষায় মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে চাই প্রফুল্ল মন। তাই ছাত্রজীবনে অবকাশ যাপন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর অবকাশ যাপনের পদ্ধতি শিক্ষামূলক হলে সেটি ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে ভালো। এ সময়ে ছাত্ররা রঙ্গিন চোখে পৃথিবীকে দেখে। নিজেদের অজান্তেই অন্ধকার জগতে পা বাড়াতে পারে। খারাপ বন্ধুদের অসৎ সঙ্গে নানা রকমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের কালো ছায়া থেকে বাঁচাতে ছাত্রজীবনের অবকাশ যাপন পদ্ধতি শিক্ষামূলক ও পরিমিত হওয়া উচিৎ। পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্রদেরকে অন্যান্য কার্যক্রমেও পারদর্শি করা দরকার। ছাত্ররা তাদের অবকাশকালীন সময়কে শিক্ষাসফর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন ও সমাজ সেবামূলক কাজে ব্যয় করার মাধ্যমে কাটাতে পারে।
৬। অবকাশ বনাম অলসতা:
কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে অবকাশ ও অলসতা এক বিষয় নয়। কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে সামান্য অবকাশ আমাদের মনে প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেয়। অবকাশ যাপনের মাধ্যমে আমরা জটিলতা ভুলে জীবনকে উপভোগ করতে পারি। যা আমাদের শরীর ও মনকে প্রফুল্ল করে। ফলে আমরা নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারি। আর অলসতা হচ্ছে আমাদের সফলতার প্রধান অন্তরায়। অলসতা একজন মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে। কোনো কাজেই উদ্যম পায় না অলস মানুষ। ফলে উন্নতি তাদের জীবনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাই আমাদের অবকাশ যাপন যেন অলসতায় পরিণত না হয়।
শেষ কথা:
কর্মব্যস্ততায় চাপা মন মাঝে মধ্যেই কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতে চায়। প্রজাপতির মতো অবাধ স্বাধীনতায় রঙ্গীন স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। হাজারো চাপে জর্জরিত মন সামান্য একটু স্নিগ্ধ অবকাশের আশায় আর্তনাদ করতে থাকে। নতুন করে জীবন শুরু করার প্রস্তুতি পর্বই হচ্ছে অবকাশ যাপন।
পোস্ট ট্যাগ -
সরকারি কর্মচারী ছুটি বিধিমালা ২০১৯ pdf , নির্ধারিত ছুটি বিধিমালা ১৯৫৯ বাংলা pdf , অবকাশ যাপন অর্থ , অবকাশ অর্থ , কাজের মাঝে অবকাশ ছুটি লাভের প্রয়োজনীয়তা কী , অবসর যাপন রচনা , অবকাশ দিয়ে , বাক্য রচনা , অবসর দিয়ে বাক্য রচনা , সরকারি ছুটি বিধিমালা ১৯৭৯ pdf , অর্জিত ছুটি মঞ্জুরের ক্ষমতা , অর্জিত ছুটি বিধিমালা